গত কয়েক মাস ধরে রাজশাহীস্থ ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনে চিকিৎসা ভিসা প্রার্থীদের প্রায় অর্ধেকের আবেদনের সঙ্গে ভারতীয় হাসপাতালের জাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট সংযুক্ত করার ঘটনা ঘটছে।অতি সম্প্রতি সহকারী হাই কমিশনের পক্ষ থেকে যাচাই করতে গিয়ে এগুলো ধরাও পড়েছে।বিষয়টি তদন্তে নেমে পুলিশ ঠাকুরগাঁও ও রাজশাহীতে ৩ জনকে আটক করেছে।এদের সবাই ভিসা প্রসেসিং সেন্টারের দোকান খুলে এই জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে,এই কাজের জন্য গড়ে উঠেছে একটি বড় সিন্ডিকেট।এতে আইভ্যাকের দুয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা, সহকারী হাই কমিশনে কর্মরত দুজন সাবেক স্থানীয় কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার কয়েকজন অসাধু ভিসা প্রসেসিং ব্যবসায়ী জড়িত।

রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) একটি সূত্র জানিয়েছে,সম্প্রতি নওগাঁর আত্রাইয়ের হেলাল আলী ও মোহন ঘোষ নামের দুজন ভিসাপ্রার্থী জালিয়াতির শিকার হয়েছেন বলে নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন।

তাদের অভিযোগ,তারা রাজশাহীর বর্ণালীর মোড়স্থ আইভ্যাক সংলগ্ন সরকার সলিউশন্স নামের দোকানে ভারতীয় ট্যুরিস্ট ভিসার জন্য আবেদন ফরম অনলাইনে পূরণের জন্য যান। এসময় তাদেরকে সেখান থেকে বলা হয় যে, ট্যুরিস্ট ভিসা পেতে বিলম্ব হবে।সে কারণে তারা তাদেরকে চিকিৎসা ভিসার আবেদনের পরামর্শ দেন।দ্রুত ভিসার পাবার জন্য তারা রাজি হলে পরবর্তীতে তাদেরকে ভারতের একটি হাসপাতালের ভুয়া অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে ভিসার আবেদন করা হয়।এজন্য তারা প্রতিজনের কাছ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা করে নেন।সহকারী হাই কমিশনে তাদের ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হবার পর তারা এই জালিয়াতি ধরতে পারেন।

তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ডিবি পুলিশ ১৩ ফেব্রুয়ারী সোমবার রহমান সলিউশন্স থেকে শেখ এনামুল হাসান ও রায়হান কবির নামের দুজনকে আটক করে।সে রাতেই এ ব্যাপারে বোয়ালিয়া থানায় একটি মামলা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট থানার ওসি।

পুলিশ জানিয়েছে,রাজশাহীতে আটক এই দুজনই চিকিৎসা ভিসার জন্য জালিয়াতিতে যুক্ত থাকার বিষয়টি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।

পুলিশকে তারা জানিয়েছেন,সম্প্রতি রাজশাহীস্থ ভারতীয় সহকারী হাই কমিশন ভারতে চিকিৎসা ভিসাপ্রার্থীদের ভিসাপ্রাপ্তি সহজ করতে উদ্যোগী হয়।এর অংশ হিসেবে স্বল্প সময়ে চিকিৎসা ভিসা প্রদান শুরু করা হয়।আর সেই সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে সাধারণ ট্যুরিস্টদেরও চিকিৎসা ভিসার জন্য আবেদন করতে উৎসাহিত করতে শুরু করে তারা।এ জন্য টাকার বিনিময়ে ভারতীয় হাসপাতালের ভুয়া অ্যাপয়েন্টমেন্টের চিঠি তৈরি করে দিতেন তারা।রাজশাহী আইভ্যাক সংলগ্ন ভিসা প্রসেসিংয়ের আরও অনেক দোকানেই এই একই কাজ হয় বলে তারা পুলিশকে তথ্য দিয়েছেন।

তাদের তথ্য মতে,দীর্ঘদিন ধরে এই জালিয়াতি চললেও সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসা ভিসাকে অগ্রাধিকার দেয়ার কারণে তারা এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার করেন।

রাজশাহীস্থ ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনের একটি সূত্র জানায়,এ অঞ্চল থেকে ভারতে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া মানুষের সুবিধার জন্য চিকিৎসা ভিসায় অগ্রাধিকার দেয়ার উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে নাটকীয়ভাবে চিকিৎসা ভিসাপ্রার্থীদের সংখ্যা লাফিয়ে বেড়ে যায়।পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়ে যায় যে,ট্যুরিস্ট ভিসার চেয়ে বেশি চিকিৎসা ভিসার আবেদন আসতে শুরু করে।তখনই আরও কঠোরভাবে হাসপাতালের অ্যাপয়েন্টমেন্ট যাচাই শুরু হয়। আর সেখানে দেখা মেলে ভয়াবহ চিত্রের।শুধু রাজশাহী নয়,বিভাগের সবগুলো আইভ্যাকেই একই পরিস্থিতি।

সূত্র জানায়,লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা এলাকার অমূল্য কুমার চিকিৎসা নিতে ভারতে যাবার জন্য ভিসার আবেদন জমা দেন গত মাসে।সংশ্লিষ্ট ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র (আইভ্যাক) থেকে নথিপত্রসহ সেটি রাজশাহীস্থ ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনে পৌঁছায়।এর সঙ্গে সংযুক্ত মেডিকেল অ্যাপয়েন্টমেন্ট যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়,ভারতের হাসপাতালের যে নথি যুক্ত করা হয়েছে তা জাল।অমূল্য কুমার ভিসা আবেদনের সঙ্গে তামিলনাড়ুর ভেলরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের অ্যাপয়েন্টমেন্টের যে কাগজ জমা দেন,সেখানে তার আইডি নম্বর দেয়া হয়েছে ৮৫৪২১০পি। অ্যাপয়েন্টমেন্টের তারিখ দেয়া হয়েছে এ বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি।

অথচ ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়,এই আইডি নম্বরের বিপরীতে প্রকৃত রোগীর নাম মুনমুন আক্তার।তার অ্যাপয়েন্টমেন্টের নির্ধারিত তারিখ ছিলো গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর।

অমূল্য কুমার দাবি করেন, ঠাকুরগাঁও আইভ্যাক সংলগ্ন ‘রায় ইন্ডিয়ান ভিসা প্রসেসিং সেন্টার’ থেকে তিনি ভিসা আবেদন করেন।সেখান থেকেই তাকে হাসপাতালের জাল অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়।এ ঘটনায় ঠাকুরগাঁও পুলিশ একজনকে আটক করেছে।

অন্যদিকে,এই জালিয়াতির সঙ্গে একটি বড় সিন্ডিকেট জড়িত থাকার তথ্য উঠে এসেছে। হাসপাতালের জাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়ে একজন ভিসার আবেদনকারী তার সঙ্গে বিভাগের একটি আইভ্যাকের একজন ভিসা এক্সিকিউটিভের ফোন কথোপকথনের অডিয়ো রেকর্ড তদন্তকারীদের হাতে তুলে দেন।সেখানে ওই ভিসা এক্সিকিউটিভকে টাকার বিনিময়ে ছয় মাস কিংবা এক বছরের ভিসা পাইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলতে শোনা যায়।পুলিশ ওই ভিসা এক্সিকিউটিভকে মঙ্গলবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে।

হাতে আসা ওই অডিও রেকর্ডে ওই ভিসা এক্সিকিউটিভকে একটি আইভ্যাকের কর্মকর্তার নামও বলতে শোনা যায়।ওই কর্মকর্তার শ্বশুরবাড়ি রাজশাহী মহানগরীর সপুরা এলাকায়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহীস্থ ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার মনোজ কুমার বলেন, “ভারত তার অন্যতম বন্ধুদেশ হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের ভিসাপ্রাপ্তির সুবিধার লক্ষ্যে কাজ করে থাকে।বিশেষ করে চিকিৎসাপ্রার্থীদের ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিকতা রয়েছে।কিন্তু সেই সুযোগ নিয়ে কেউ অপরাধ করলে সেটা দুঃখজনক।আমরা আশা করি জড়িতদের ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রশাসন যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেবে।”এছাড়া আইভ্যাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কেউ এমন ঘটনায় জড়িত থাকলে তারা অফিসিয়ালি তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন বলেও জানান।